আইবিএস রোগীর খাবার তালিকা-আইবিএস রোগ থেকে মুক্তির উপায়।
আইবিএস রোগীর খাবার তালিকা জানার আগে আইবিএস কি তা জানতে হবে। আইবিএস হল দীর্ঘমেয়াদি একটি পেটের রোগের নাম। আইবিএস নামক পেটের এই রোগের সম্পূর্ণ নাম হল ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম। আইবিএসকে পেটের রোগ বলা হলেও রোগটি কিন্তু মানসিক চাপের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। মানসিক চাপ বাড়লে আইবিএস এর উপসর্গ গুলো বাড়ে। তাই আইবিএস রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মানসিক চাপ কমাতে হবে।
তাছাড়া আমাদের খাদ্যাভ্যাস আইবিএস এর সাথে সম্পর্কিত। আইবিএস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে কোন খাবারগুলো খেতে হবে এবং কোন কোন খাবারগুলো খাওয়া যাবে না তা আমাদের জানতে হবে। সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন আশা করি আইবিএস সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জেনে যাবেন।আইবিএস কেন হয় তা এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে জানা যায়নি। যদিও আইবিএস মৃত্যুর কারণ নয় তবে এটি একটি যন্ত্রণাদায়ক ক্রনিক রোগ।
আইবিএস রোগে আক্রান্ত রোগী রোগ মুক্তির আশায় একের পর এক ডাক্তার দেখায়। রোগটি থেকে মুক্তি পেতে হলে রোগীকে অবশ্যই ঔষধ সেবনের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে।
পোস্ট সূচিপত্র:
আইবিএস এর লক্ষণ
আইবিএস হলে কি কি সমস্যা হয় অর্থাৎ আইবিএস এর উপসর্গ গুলি আমাদের জানা দরকার। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে। মলত্যাগের পর পেটে ব্যথা ও পেট ফাঁপা কমে যায়। যার ফলে রোগী আরাম পায়।
ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা আইবিএস শনাক্তকরণের জন্য এর লক্ষণ গুলো জানা প্রয়োজন। তাহলে লক্ষণগুলো জেনে নেয়া যাক। আইবিএস-এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে
- ডায়রিয়া।
- কোষ্ঠকাঠিন্য।
- অনেকের পর্যায়ক্রমে ডায়রিয়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য চলতে থাকে।
- পেটে ব্যথা করা, পেট ব্যথা সাধারণত তলপেটে হয়, কোন কিছু খাওয়ার পর ব্যথা বাড়ে এবং মলত্যাগের পর ব্যথা কমে।
- পেটে গ্যাস হয়, গ্যাসে পেট ফুলে যায়।
- অনেকের পায়খানার সাথে মিউকাস দেখা যায়।
- মলত্যাগের কিছুক্ষণ পরেই আবার মলত্যাগের ইচ্ছা হয়।
- বদহজম ও হার্টবার্ন হতে পারে।
- মাথাব্যথা, ক্লান্ত লাগা, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা।
সঠিকভাবে আইবিএস শনাক্তকরণের জন্য এই লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্তত দুটি লক্ষণ কমপক্ষে ৩ মাস স্থায়ী হতে হবে। মানসিক চাপ ও মহিলাদের পিরিয়ডের সময় উপসর্গগুলি আরো যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে।
আইবিএস থেকে মুক্তির উপায় ও চিকিৎসা
ডাক্তারদের মতে এখন পর্যন্ত আইবিএসের কোন প্রতিকার নেই। চিকিৎসা বলতে উপসর্গগুলোকে কমাতে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ওষুধ সেবনের পাশাপাশি জীবনযাত্রার পরিবর্তন আবশ্যক। আইবিএসের প্রতিকার না থাকলেও ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে চললে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রোগটি যেহেতু মানসিক চাপের সাথে সরাসরি যুক্ত তাই গ্যাস্ট্রোলিভার ও মানসিক রোগের চিকিৎসক একসাথে দেখাতে হবে।
আইবিএস এর ঘরোয়া চিকিৎসা
ঘরোয়া প্রতিকারে আইবিএস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ঘরোয়া প্রতিকারের সবটুকু অংশজুড়ে রয়েছে লাইফ স্টাইল বা জীবনযাত্রার পরিবর্তন। আসুন জেনে নেওয়া যাক আইবিএস নিয়ন্ত্রণে ঘরোয়া প্রতিকার সম্পর্কে-
- নিয়মিত ব্যায়াম করা।
- আইবিএস ক্যাফিন অন্ত্রকে উদ্দীপিত করে তাই ক্যাফিনযুক্ত পানীয় পান করা যাবে না।
- মানসিক চাপ কমাতে হবে। প্রয়োজন হলে মানসিক রোগের ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
- প্রোবায়োটিক যুক্ত খাবার খেতে হবে। প্রোবায়োটিক হজম শক্তি বৃদ্ধি করে, পেট ফাঁপা ও পেটের গ্যাস কমায়। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট খেতে হবে।
- ভাজাপোড়া, ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া যাবেনা।
আইবিএস এর ব্যথা
আইবিএস রোগীদের মলত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন ও পেটে ব্যাথা এই দুটি একবারে কমন সমস্যা। এই ব্যথা অনেকটা ক্র্যাম্পিংয়ের মত অনুভব হয়। ব্যথার পাশাপাশি পেটের অন্যান্য সমস্যা গুলোর মধ্যে রয়েছে-
- ঘন ঘন মলত্যাগ।
- মলত্যাগের পর ব্যথা কিছুটা কমে যাওয়া।
- পর্যায়ক্রমে ডায়রিয়া ও কনস্টিপেশন চলতে থাকা।
আইবিএস রোগীর খাবার তালিকা
আইবিএস রোগীকে খাবার নিয়ে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। সহজে হজম হয় এমন সব খাবার খেতে হবে এবং যে সব খাবার হজমের সমস্যা করে এমন ধরনের খাবার খাওয়া যাবেনা। তবে সব আইবিএস রোগীর একই ধরনের উপসর্গ বা লক্ষণ থাকে না।
আইবিএস মূলত দুই ধরনের হয়-
যার একটি হলো আইবিএস রিলেটেড ডায়রিয়া। এক্ষেত্রে আইবিএস এর কারণে রোগীর ঘনঘন ডায়রিয়া হয়। অপরটি আইবিএস রিলেটেড কনস্টিপেশন এবং এই ধরনের আইবিএস রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্য যেন ছাড়তেই চায় না।
আইবিএস রিলেটেড কনস্টিপেশনে খাওয়া যাবেনা-
অনেক খাবার রয়েছে যেগুলো আইবিএস রিলেটেড কনস্টিপেশনকে আরো জটিল করে ফেলে। তাই এই ধরনের খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এই ধরনের খাবার গুলোর মধ্যে রয়েছে-
- সাদা আটা ও চাল দিয়ে তৈরি সব ধরনের খাবার। যেমনঃ সাদাভাত, সাদা রুটি, পাউরুটি, বিস্কুট ইত্যাদি।
- যেকোনো ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবার
- ক্যাফিন যুক্ত পানীয়, কার্বনেট যুক্ত পানীয় ও অ্যালকোহল ইত্যাদি বিরত থাকতে হবে।
- হাই প্রোটিন জাতীয় খাবার
- দুগ্ধজাত খাবার বিশেষ করে দুধ, পনির ইত্যাদি।
- শালগম, ব্রোকলি, পাতাকপি, ফুলকপি, মুলা ইত্যাদি সবজি খাওয়া যাবেনা।
আইবিএস রিলেটেড কনস্টিপেশনে যা খাবেন
আইবিএস রিলেটেড কনস্টিপেশন প্রতিরোধে-
-পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। পানি মল নরম করে কনস্টিপেশন প্রতিরোধে সহায়তা করে।
-প্রচুর পরিমাণে দ্রবণীয় আঁশ বা সলিউবল ফাইবার জাতীয় খাবার গুলো খেতে হবে। যেমনঃ সাইট্রাস ফল, ডাল, বাদাম, মিষ্টি আলু, নাশপাতি, গাজর ও শসা ইত্যাদি।
পেট ভরে খাবার না খেয়ে একটু পর পর অল্প অল্প করে খেতে হবে। আশাকরি আইবিএস রিলেটেড কনস্টিপেশন থেকে মুক্তি পেতে এই নিয়মগুলো মেনে চললে অনেক উপকারে আসবে।
আইবিএস রিলেটেড ডায়রিয়ায় করণীয়
অনেক খাবার রয়েছে যেগুলো আইবিএস রিলেটেড ডায়রিয়া আরো জটিল করে ফেলে। এই ধরনের খাবার গুলো অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- বেশি পরিমাণে ফাইবার রয়েছে এমন খাবার বিশেষ করে অদ্রবণীয় আঁশ বা ইনসলিউবল ফাইবার যুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমনঃ বাদাম, আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি খাবারে ইনসলিউবল ফাইবার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদ্যমান থাকে। তাই আইবিএস রিলেটেড ডায়রিয়ায় এই ধরনের খাবারগুলো খাওয়া যাবেনা।
- চকোলেট,অ্যালকোহল, ক্যাফিন, সরবিটল সমৃদ্ধ খাবার ও পানীয়
- কার্বনেট যুক্ত পানীয়
- দুগ্ধজাত দ্রব্য
- ভাজা ও চর্বিযুক্ত খাবার
- গ্লুটেন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া যাবে না। যেমনঃ গম ও গম দিয়ে তৈরি যেকোনো খাবার।
- মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া যাবেনা
- খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খেতে হবে
আইবিএস রিলেটেড ডায়রিয়ায় পরিমিত পরিমাণে দ্রবণীয় আঁশযুক্ত খাবার বা সলিউবল ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। শুকনো ফলে সলিউবল ফাইবার রয়েছে। জাতীয় খাবারের পরিবর্তে খেতে হবে নরম ভাত। যে খাবার খেলে পেটে গ্যাস, বদহজম ও ডায়রিয়া হলে খাবারটি খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে।
আইবিএস হলে কি ওজন কমে?
আইবিএস এর সাথে শরীরের ওজনের একটি সম্পর্ক রয়েছে। অনেকের এই রোগটির কারণে ওজন কমতে পারে। বিশেষ করে আইবিএস রিলেটেড ডায়রিয়ায় টানা ৫-৬ দিন ডায়রিয়া থাকার কারণে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে ইলেক্ট্রোলাইট বেরিয়ে যায়। রোগী পুষ্টিকর খাবার গুলো খেতে চায় না, খাবার খেতে মন চায় না। ডায়রিয়া থেকে সুস্থ হওয়ার পরেও খাবারের রুচি ফিরে আসতে অনেকটা সময় লাগে। সঠিক মাত্রায় ডায়েট গ্রহণের অভাবে আইবিএস রোগীর ওজন কমতে পারে।
শেষ কথা- আশা করি, আইবিএস রোগীর খাবার তালিকা ও এই রোগটি থেকে মুক্তির উপায় জানাতে পেরেছি। মুক্তির উপায় বলতে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণের উপায় বোঝানো হয়েছে। রোগটির সাথে মানসিক চাপের একটা সম্পর্ক রয়েছে। মানসিক চাপ কমালে আইবিএস এর উপসর্গগুলোর কমবে। পাশাপাশি খাবারের প্রতি থাকতে হবে বিশেষ সতর্কতা। কনস্টিপেশন ও ডায়রিয়া জটিল করে তুলে এমন খাবার গুলো এড়িয়ে চলতে হবে। আইবিএস দীর্ঘমেয়াদি রোগ হলেও জটিল রোগ নয় যা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
Nice post