গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসের সতর্কতা।
গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসের সতর্কতা একজন গর্ভবতী মা ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জানা প্রয়োজন।গর্ভাবস্থার শেষের তিন মাস মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়।
এই সময়টাতে একজন গর্ভবতী মাকে কিছুটা সতর্ক থাকতে হবে। তার লাইফ স্টাইল বা জীবনযাত্রার ধরনের কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। তার খাবার, ঘুম, হাটা চলার ধরন, পোশাকের ধরন ও প্রকৃতি ইত্যাদি যেন সন্তানের ক্ষতির কারণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
একজন গর্ভবতী মাকে গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসের সতর্কতা অর্থাৎ এই সময়টাতে তাকে কোন কোন বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে হবে সে সম্পর্কে এই আটিকেলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসে কোন কোন খাবারগুলো মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী সে সম্পর্কেও জানানো হয়েছে। তাই গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসের সতর্কতা সম্পর্কে জানতে এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
পোস্ট সূচিপত্র:
গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসের সতর্কতা-
গর্ভবতী মায়ের গর্ভধারণ থেকে প্রসবের সময় পর্যন্ত সময়কে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম মাস থেকে তিনমাস পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার,চার মাস থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সময়কে বলা হয় সেকেন্ড ট্রাইমেস্টার,৭ম মাস থেকে প্রসব কাল পর্যন্ত যে সময়টা সেটাকে থার্ড ট্রাইমেস্টার(Third trimester) বলা হয়।
একজন গর্ভবতী মাকে তার গর্ভাবস্থায় সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। বিশেষ করে থার্ড ট্রাইমেস্টারে অর্থাৎ গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাস গর্ভবতী মায়েদের কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে সেগুলো জেনে নেওয়া যাক।
গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ও গর্ভাবতীর যত্ন-
গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসে অর্থাৎ থার্ড ট্রাইমেস্টারে একজন গর্ভবতী মা শারীরিক ও মানসিক নানা ধরনের জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। শারীরিক সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে-
গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসঃ গর্ভবতী মায়েরা উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি রয়েছে। কারণ গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন ধরনের হরমোনের পরিবর্তন হয়। তাছাড়া গর্ভবতী মায়েদের ওজন বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ওজন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের একটি অন্যতম কারণ।
যদি পরিবারের কারও ডায়াবেটিস থাকে সেক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই এই সময়ে একজন গর্ভবতী মাকে নিয়মিত রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। যদি উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পাওয়া যায় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মা ও শিশুর দ্রুত ওজন বৃদ্ধিঃ গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসে শিশুর ওজন দ্রুত বাড়তে থাকে। এজন্য এই সময়ে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। চর্বি ও অন্যান্য যেসকল খাবার দ্রুত ওজন বাড়ায় সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজন ডাক্তারের পরামর্শ, এই সময়ে ডাক্তার মা ও শিশুর ওজনের উপর ভিত্তি করে ডায়েট গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকে। যদি শিশুর ওজন প্রয়োজনের চেয়ে কম হয় তাহলে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারগুলো খাওয়ার পরামর্শ দিতে পারে।
পা ও পায়ের গোড়ালি ফুলে যাওয়ারঃ শরীরের ওজন বৃদ্ধির পাশাপাশি থার্ড ট্রাইমেস্টারে একজন গর্ভবতী মহিলার পা ও পায়ের গোড়ালি ফুলে যেতে পারে। এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু পা এবং গোড়ালি যদি অস্বাভাবিক ভাবে ফুলে যায় সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ অতিরিক্ত ওজন প্রি এক্লাম্পসিয়ার একটি কারণ। প্রি-এক্লাম্পসিয়া প্রতিরোধে ডাক্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
স্তন ও জরায়ু বৃদ্ধি পাওয়াঃ গর্ভাবস্থায় শেষ তিন মাসে গর্ভাবতীর স্তন ও জরায়ু বৃদ্ধি পায় যা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
ঘন ঘন প্রস্রাবঃ সাধারণত গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। যার কারণ হলো গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তন। গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসে এ সমস্যাটি আরো বেড়ে যায়। কারণ এই সময়ে শিশুর ওজন বৃদ্ধি অর্থাৎ জরায়ু বেড়ে যায় এবং মূত্রাশয়ে চাপ দেয়। ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণে রাতে ঘুমাতে সমস্যা হতে পারে। তাই রাতে খুব বেশি পরিমাণে পানি পান ও অন্যান্য তরল খাবার খাওয়া যাবেনা।
ঘুমের সমস্যাঃ গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসে রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে পিঠে ভর দিয়ে ঘুমাতে বেশি অসুবিধা হয়। এছাড়া ঘন ঘন প্রস্রাব, ব্যথা ও অস্বস্তির কারণে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।
অন্যান্য সমস্যাঃ এ সময়ে হার্ট বার্ন অর্থাৎ বুকজ্বালা হতে পারে গর্ভবতী মায়ের।
মনে রাখবেন অতিরিক্ত বমি, হঠাৎ করে শিশুর নড়াচড়া কমে যাওয়া, অতিরিক্ত রক্তপাত ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত একজন গাইনী চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় মানসিক পরিবর্তন-
গর্ভাবস্থায় মানসিক পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে থার্ড ট্রাইমেস্টারে হরমোনের পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিক পরিবর্তন ঘটে। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় ঘুমের ব্যাঘাত মানসিক পরিবর্তনের একটি কারণ। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে, অল্পতেই হতাশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। পরিবারকে অবশ্যই এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। তাকে সব ধরনের মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসে করণীয়-
গর্ভবতী মাকে অবশ্যই জানতে হবে গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসে লাইফ স্টাইল কেমন হবে। কতগুলো বিষয় রয়েছে যেগুলো গর্ভবতী মাকে এড়িয়ে চলতে হবে। কেননা মায়ের জন্য এগুলো ঝুঁকির কারণ হতে পারে। যেমনঃ
- যেহেতু গর্ভাবস্থায় শরীরের ওজন বৃদ্ধি পায় তাই ওঠা বসা করতে কিছুটা সমস্যা হবে। ধীরে ধীরে ওঠা বসা করতে হবে একদম তাড়াহুড়া করা যাবে না।
- গর্ভবতী মাকে বসার পজিশন ঠিক রাখতে হবে, দীর্ঘ সময় ধরে পা ঝুলিয়ে বসলে পায়ে ব্যথা ও পা ফুলে যেতে পারে। তাই পা ঝুলিয়ে বসার ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে।
- গর্ভবতী নারী ভারী কাজকর্ম ও ব্যায়াম করতে পারবে। তবে সাধারণ কাজকর্ম চালিয়ে যেতে হবে। পূর্ণ বিশ্রাম উচিত নয়, হাঁটাচলা ও ছোটখাটো কাজ কর্ম করতে হবে।
- ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। গর্ভাবস্থায় যেকোন সমস্যা ডাক্তারকে জানাতে হবে, অবহেলা উচিত নয়।
- গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের নির্দেশ ব্যতীত কোনো ওষুধ সেবন উচিত নয়। কেননা এই সময়টাতে অনেক ওষুধ সেবন করা নিষিদ্ধ। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে এমন ধরনের ওষুধ সেবন করা যাবে না। তাই ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া কোন ওষুধ সেবন নয়।
- পরিবারের উচিত একজন গর্ভবতী মায়ের খেয়াল রাখা। তাছাড়া মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের অবস্থা জানার জন্য শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পাশাপাশি ডাক্তার মেডিকেল টেস্ট দিতে পারে। ডাক্তার যে টেস্টগুলো দিবে সেগুলো করার পর রিপোর্ট দেখাতে হবে।
গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসের খাদ্য তালিকা-
এই সময়টাতে শিশুর ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ফলে তার পুষ্টির চাহিদাও বেড়ে যায়। আর এজন্যই গর্ভবতী মাকে এ সময়ে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
- থার্ড ট্রাইমেস্টারে(Third trimester) রক্তস্বল্পতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এই সময়ে বেশি বেশি আয়রন যুক্ত খাবার খেতে হবে। বাদাম, কলা, ডাবের পানি, পালং শাক, মটরশুটি, মসুর ডাল, সবুজ শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি খাবারে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে। সর্বাধিক পরিমাণে আয়রন শোষণে প্রয়োজন ভিটামিন সি। সাইট্রাস ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি।
- এই সময়ে শিশুর হাড়কে মজবুত করার জন্য প্রয়োজন ক্যালসিয়াম। ডেইরি মিল্ক,ব্রকলি ইত্যাদি খাবার রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম যা গর্ভবতী মায়েদের ক্যালসিয়ামের যোগান দিতে পারে।
- এই সময়ে গর্ভবতীর বাড়তি ক্যালোরি প্রয়োজন। কিসমিস, খেজুর ইত্যাদি শুকনো ফল যোগান দেবে বাড়তি ক্যালোরির।
- মাছ, ডিম, ডাল ও অন্যান্য প্রোটিন জাতীয় খাবার কতটুকু পরিমাণে খেতে হবে সেটা নির্ভর করবে শিশুর ওজনের উপর। ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর ওজন জানার পর প্রোটিন জাতীয় খাবার কতটুকু পরিমাণে খেতে হবে সেটা নির্ধারণ করে দিবে।
- এই সময়ে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করবে। বাদামী চাল, শাকসবজি, মটরশুটি, নারিকেল, কাজু বাদাম, চিনাবাদাম ইত্যাদি খাবারে রয়েছে ফাইবার।
এই সময়ে বাড়তি পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ফলিক অ্যাসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
গর্ভাবস্থায় যে সকল খাবার খাওয়া উচিত নয়-
গর্ভাবস্থায় কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। যেমনঃ
- কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ শাকসবজি গর্ভাবস্থায় খাওয়া উচিত নয়। কেননা খাবারের কারণে বদহজম যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অবশ্যই শাকসবজি খেতে হবে কিন্তু সেটা তাজা ও ভালো ভাবে রান্না করা হতে হবে।
- যেহেতু গর্ভাবস্থায় বিশেষ করে থার্ড ট্রাইমিস্টারে উচ্চ রক্তচাপের একটা ঝুঁকি থাকে তাই খুব বেশি লবণ খাওয়া যাবেনা। তাছাড়া লবণ ও অন্যান্য লবণযুক্ত খাবার বেশি খাওয়ার ফলে পায়ে পানি আসতে পারে।
- এই সময়ে ঝাল, ঝাঁঝালো, তৈলাক্ত ও ক্যাফেইন জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এই ধরনের খাবার শরীরের ওজন বাড়িয়ে দিতে পারে।
- গর্ভাবস্থায় উচ্চ শর্করা জাতীয় খাবার গুলো না খাওয়াই ভালো। কেননা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি রয়েছে। তাই মিষ্টি, মিষ্টি জাতীয় খাবার অথবা উচ্চ শর্করা জাতীয় যে কোন খাবার খাওয়া উচিত নয়।
শেষ কথাঃ
আশা করি, গর্ভাবস্থায় শেষ ৩ মাসের সতর্কতা আপনাদের জানাতে পেরেছি। গর্ভবতী মায়ের এই সময়ে কোন স্বাস্থ্যসমস্যা অথবা বিপজ্জনক লক্ষণ দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাসপাতালে অথবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। গর্ভবতী মা ও তার শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য সর্বদা থাকতে হবে সতর্ক।
জরিপ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url